নেতানিয়াহু ও পুতিনের সামনে যুদ্ধই টিকে থাকার একমাত্র পথ

নাৎসি জার্মানির পরাজয়ের ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চলতি মাসের শুরুতে এক বন্ধুত্বপূর্ণ টেলিফোন আলাপ করেছেন। এই দুই নেতা অনেক কিছুতেই একে অপরের সঙ্গে মিলে যান। দুজনই দাবি করেন, তারা এখনো বীরের মতো নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়ছেন—নেতানিয়াহু গাজায় আর পুতিন ইউক্রেনে। এই কল্পিত যুদ্ধ তাদের হাতে বেসামরিক মানুষ হত্যা, সেনাদের প্রাণহানি এবং বিপুল অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষতির ন্যায্যতা দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। হয়তো এই গল্পগুলো তাদের রাতে ঘুমাতে সাহায্য করে।
‘বিবি’ ও ‘ভ্লাদ’—বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত অপরাধী, এবং সম্ভবত সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। হাজার হাজার শিশুকে নির্বিচারে হত্যা ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করার নেতৃত্ব দেওয়াটা তাদের একটি সাধারণ আচরণ। এই দুই স্বৈরাচারী ‘শক্ত নেতা’ তাদের নিজ নিজ দেশকে বিশ্বমঞ্চে একঘরে ও নৈতিকভাবে ধ্বংস করে দিয়েছেন। যুদ্ধই তাদের ক্ষমতায় রাখে। তারা দেশপ্রেমের নাম করে অভ্যন্তরীণ বিরোধীদের দমন করেন এবং আন্তর্জাতিক সমালোচকদের ইহুদিবিদ্বেষী, সন্ত্রাসবাদ-সহানুভূতিশীল বা রুশবিদ্বেষী বলে দাগিয়ে দেন। তারা যুদ্ধ করে, কারণ তারা শান্তিকে ভয় পান।
দুজনের বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। নেতানিয়াহু ও তার কট্টর ডানপন্থী মিত্ররা ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিকার অস্বীকার করেন। পুতিনও ইউক্রেনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মানতে নারাজ। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে রয়েছে বর্ণবাদী, উগ্র-জাতীয়তাবাদী মানসিকতা—‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ বা ‘পুনর্জন্মলাভ করা সোভিয়েত সাম্রাজ্য’-এর কল্পনা।
ইউরোপীয় নেতারা আশঙ্কা করছেন, পুতিন যদি শাস্তি এড়িয়ে যান, তাহলে একসময় তিনি ইউরোপের দিকেও অস্ত্র তাক করবেন। ইতোমধ্যেই নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়েছেন লেবানন, ইয়েমেন ও সিরিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ গোয়েন্দা তথ্য বলছে, তিনি ইরানেও হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যাতে ওয়াশিংটন-তেহরান পরমাণু আলোচনা ভেস্তে যায়। তবে সবচেয়ে বড় মিল হলো—এই দুই নেতা আসলে কখনোই শান্তি চান না।
তাদের টিকে থাকার জন্য সহিংসতা জরুরি। লড়াই থেমে গেলে তারা জানেন, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে জবাবদিহি। পুতিনের ব্যর্থ জুয়ার মূল্য যখন রাশিয়ার অভিজাত শ্রেণি উপলব্ধি করবে, তখন তার দিন গোনা শুরু হবে। নেতানিয়াহুর সামনে আছে নির্বাচনী পরাজয়, এরপর ঘুষ ও দুর্নীতির মামলায় জেলও হতে পারে।
তাই তারা শান্তিকে ভয় পান। আর এই যুদ্ধ বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কড়া অবস্থান, ইউক্রেনকে সামরিক-অর্থনৈতিক সহায়তা এবং ইসরায়েল সরকারের ওপর চাপই হতে পারে এই যুগলের অবসানের পথ।
এ কারণেই তারা টেলিফোনে একে অপরকে উষ্ণ শুভেচ্ছা জানান—এখন তারা একে অপরকে দরকার। হয়তো তারা ব্রিটিশ বিরোধী নেতা কিয়ার স্টারমারকে দমন করার কৌশল নিয়ে আলোচনা করেছেন, যেমন নেতানিয়াহু সম্প্রতি চেষ্টা করেছেন। নেতানিয়াহু মনে করেন, ৭ অক্টোবর ২০২৩–এর হামাসের নৃশংসতা তাকে যেকোনো কাজ করার বৈধতা দেয়। কিন্তু তিনি ভুল।
হয়তো তারা ট্রাম্পকে কীভাবে প্রভাবিত, খুশি এবং বিভ্রান্ত করা যায়, সে নিয়েও পরামর্শ করেছেন। নেতানিয়াহু–পুতিন–ট্রাম্প ত্রয়ী এখন বিশ্বে শান্তির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের বিশৃঙ্খল নীতি এখন তার দ্বিতীয় মেয়াদে আরও বিপজ্জনকভাবে অগোছালো হয়ে উঠছে। যুদ্ধ থামাতে এবং এই যুগলের অবসান ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্রকে তার মিত্রদের সঙ্গে মিলে চাপ বাড়াতে হবে।
কিন্তু এখন ঘটছে তার উল্টো।
সাম্প্রতিক উপসাগরীয় দেশগুলো সফরে ট্রাম্প একজন রাস্তার ফেরিওয়ালার মতো আচরণ করেছেন, একজন প্রেসিডেন্টের মতো নয়। তিনি গাজায় ক্ষুধার্ত মানুষের প্রতি উদাসীন, নেতানিয়াহুর বাড়াবাড়ি রুখতেই কেবল ইরানে হামলা ঠেকাতে চাইছেন। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তিনি ফিলিস্তিন ইস্যুতে মনোভাব বদলেছেন।
গাজা নিয়ে তার কল্পিত ‘রিভিয়েরা’ পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি বিষয়টিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। যদি গাজায় সাময়িক যুদ্ধবিরতি আবার কার্যকর হয় এবং আরও বন্দিমুক্তি ঘটে, তাহলে ট্রাম্পই এর কৃতিত্ব নিতে চাইবেন।
কিন্তু মূল সমস্যা রয়ে যাবে—তিনি একজন উগ্র প্রধানমন্ত্রী ও কট্টরপন্থী সরকারকে সমর্থন ও অস্ত্র দিচ্ছেন, যারা হামাসের অপরাধকে পুঁজি করে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে, এমনকি ফের গণহত্যার হুমকি দিচ্ছে।
ইউক্রেন ইস্যুতেও ট্রাম্পের ভূমিকা নেতিবাচক। সম্প্রতি ব্রিটেন-ফ্রান্স-জার্মানি-পোল্যান্ডের একসঙ্গে দেওয়া যুদ্ধবিরতির আহ্বান তিনি নস্যাৎ করে দিয়েছেন। আর রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় আবারও নতি স্বীকার করেছেন। ফলে পুতিন তাকে ব্যবহার করে আমেরিকা ও ইউরোপের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছেন।
শুধু যদি ট্রাম্প বুঝতেন, তিনি ঈশ্বর বা পোপ নন, বরং একজন মানুষ যিনি সব সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না।
তাহলেই গাজা ও ইউক্রেনে এক চিলতে আশার আলো ফুটত। এখন তিনি রাগে বলছেন, সব ছেড়ে দেবেন। যদি সত্যিই তাই করতেন!
যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বমঞ্চে সক্রিয় থাকতে হবে, কিন্তু শান্তির স্বার্থে ট্রাম্পের নীরবতা অনেক বেশি সহায়ক হতে পারে। কারণ প্রতিদিন নেতানিয়াহু ও পুতিন খুন করে পার পেয়ে যাচ্ছেন, অনেকাংশেই তাদের এই হঠকারী, আত্মমুগ্ধ ‘হোয়াইট হাউস ভাই’-এর কারণে। প্রতিদিন আরও শিশুর জীবন ধ্বংস হচ্ছে।
ট্রাম্পের উচিত বড় বড় কথা বলা বন্ধ করে, গাজা ও ইউক্রেন ইস্যু অভিজ্ঞ কূটনীতিক, জাতিসংঘ দূত, আরব-ইউরোপীয় মধ্যস্থতাকারী, গোয়েন্দা ও সামরিক বিশেষজ্ঞদের হাতে তুলে দেওয়া—যারা জানেন কী করতে হবে। নেতানিয়াহু ও পুতিনের ক্ষেত্রে, তার উচিত তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা।
সূত্র: Simon Tisdall, The Guardian Weekly