রাফাল ভূপাতিত হওয়া ভারতের জন্য কী বার্তা বহন করে?

পাকিস্তান দাবি করেছে, ৭ মে ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে করা হামলার পরপরই তারা ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভারতীয় আকাশসীমায় ভূপাতিত করেছে। ওই হামলায় অন্তত ৩১ জন বেসামরিক পাকিস্তানি নিহত হয়েছেন।এই হামলার পর ভারতীয় পাঁচটি যুদ্ধবিমান, যার মধ্যে রয়েছে অত্যাধুনিক ফ্রেঞ্চ যুদ্ধবিমান রাফাল, গুলি করে ভূপাতিত করার খবর সামনে আসার পর ভারত ও পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর প্রযুক্তিগত সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে— যারা দিন দিন আরও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হচ্ছে।
সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব বিমান ভূপাতিত হওয়ার বিষয়টি যদি স্বাধীনভাবে নিশ্চিত হয়, তবে তা চলমান সামরিক উত্তেজনা প্রশমনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
একজন উচ্চপদস্থ ফরাসি কর্মকর্তা মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-কে বলেছেন, পাকিস্তান সত্যিই ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি রাফাল যুদ্ধবিমান গুলি করে নামিয়েছে। এটি হতে পারে ফরাসি প্রযুক্তিতে নির্মিত এই অত্যাধুনিক বিমানের প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রের ক্ষতি।ফরাসি থিঙ্ক ট্যাংক ‘ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চ’-এর সঙ্গে যুক্ত দক্ষিণ এশীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক জিল বোকারা টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন “যদি সত্যিই রাফাল যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়ে থাকে, তাহলে এটি উত্তেজনা বৃদ্ধির বড় একটি ধাপ হতে পারে”।
রাফাল হলো একটি ৪.৫ প্রজন্মের মাল্টিরোল ফাইটার জেট, যেটি ভারত ২০২০-২২ সালে ফরাসি কোম্পানি দাসোঁ থেকে কিনেছে। এটি বর্তমানে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সবচেয়ে উন্নত ও ক্ষমতাধর বিমান।ভারত ৩৬টি রাফালের জন্য আনুমানিক ৮.৭ থেকে ৯.৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে।
যদি এসব বিমান ভূপাতিত হওয়া নিশ্চিত হয়, তবে তা শুধু নয়াদিল্লির সামরিক সুনামেই ধাক্কা দেবে না, বরং পাকিস্তানের আধুনিকায়িত বিমান শক্তিকে অবমূল্যায়নের প্রমাণও হতে পারে— বিশেষ করে তাদের চীনের সরবরাহকৃত জে-১০সি বিমান ব্যবস্থাকে।
“এই রাফাল বিমান ভারতীয় বিমানবাহিনীর সবচেয়ে উন্নত সম্পদ, এটি হারানো ভারতের বিমানবাহিনীর জন্য বড় ধরনের লজ্জার হবে,” বলেন বোকারা।
নিউ ইয়র্ক টাইমস তিনজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে “কিছু ভারতীয় বিমান ভূপাতিত হয়েছে,” যদিও বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।
বোকারা বলেন, “এর অর্থ হতে পারে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর (PAF) কার্যক্ষমতা যথাযথভাবে বিবেচনা করেনি ভারতীয় বিমানবাহিনী।” তিনি আরও যোগ করেন, ভারত সম্ভবত পরবর্তী সময়ে স্থল থেকে স্থলে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করবে।ইসলামাবাদে ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর আওতাধীন আর্মস কন্ট্রোল অ্যান্ড ডিজআর্মামেন্ট সেন্টারের পরিচালক মালিক কাসিম মুস্তাফা টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন, তিনটি ফরাসি রাফাল যুদ্ধবিমান গুলি করে নামানো বিশ্বব্যাপী অন্যতম উন্নত ও বহুমুখী যুদ্ধবিমান প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান দাসোঁ অ্যাভিয়েশনের জন্য “গভীর উদ্বেগের বিষয়।"
তিনি বলেন, “এটি দাসোঁর ভবিষ্যতের চুক্তিগুলোর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।”
মাত্র এক মাস আগেই ভারত ফ্রান্সের সঙ্গে ২৬টি নৌবাহিনীর রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার জন্য ৭.৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে। মুস্তাফা বলেন, “এই ঘটনার তদন্তে রাফালের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান দাসোঁ অ্যাভিয়েশন নিজ উদ্যোগে অংশ নিতে পারে।”
প্রযুক্তির পরিবর্তনে পাল্টেছে আকাশযুদ্ধের ধরন
নিজ নিজ দাবিমতে, ৭ মে ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই নিজ নিজ আকাশসীমা থেকে দূরপাল্লার নির্ভুল হামলা চালিয়েছে।
২০১৯ সালের বালাকোট সংকটের সময়কার উত্তেজনার তুলনায় এবারের দুই পক্ষের কৌশলগত সংযম ছিল লক্ষ্যণীয়, যখন পাকিস্তানি জেট ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে পাল্টা হামলা চালিয়েছিল।বিশ্লেষকদের মতে, দেশের অভ্যন্তরে সামরিক প্রতিক্রিয়ার চাপ ও আন্তর্জাতিক সংযমের আহ্বান, উভয় বিষয়ই এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।এছাড়াও, স্ট্যান্ড-অফ অস্ত্র ব্যবস্থার আধুনিকায়ন— অর্থাৎ এমন ক্ষেপণাস্ত্র যা দীর্ঘ দূরত্ব থেকে ছোড়া যায়— এই দু’দেশকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম করেছে সীমান্ত লঙ্ঘন না করেই।
মুস্তাফা বলেন, “যখন প্রযুক্তি আপনাকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের সুযোগ দেয়, তখন আর আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করার দরকার পড়ে না।”
দুই দেশই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মারাত্মক অস্ত্রে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে। ভারত বর্তমানে ৩৬টি রাফাল পরিচালনা করছে। যদিও এটি স্টেলথ নয়, তবুও এর ‘লো প্রোফাইল’ বা রাডারে ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম থাকার বিষয়টি জোর দিয়ে বলা হয়।
এই বিমানগুলোতে রয়েছে স্কাল্প ও মিটিওর ক্ষেপণাস্ত্র, যেগুলো ১৫০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসে সক্ষম।
অন্যদিকে, পাকিস্তান ২০২২ সালে ২৫টি জে-১০সি যুদ্ধবিমান অন্তর্ভুক্ত করেছে। এটি চীনা তৈরি আধুনিক ফাইটার জেট, যার সঙ্গে আছে PL-15 নামের দূরপাল্লার এয়ার-টু-এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র, যা মূলত চীন নিজেদের ব্যবহারের জন্য তৈরি করেছে।
প্রতিবেদন বলছে, এই দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবারই প্রথম সরাসরি যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে।বোকারা জানান, ৭ মে ভারত যে লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করেছে, সেগুলো এতটাই সীমান্তের কাছাকাছি ছিল যে ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলোর পাকিস্তানি আকাশসীমায় প্রবেশ করার প্রয়োজন হয়নি।সীমান্ত লঙ্ঘন না করার কৌশল সরাসরি ডগফাইট বা পাইলট বন্দি হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে দিয়েছে— যেমনটা ২০১৯ সালে হয়েছিল, যখন ভারতীয় পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে পাকিস্তান বন্দি করেছিল।
বোকারা বলেন, “আপনি যখন নিজের আকাশসীমা থেকেই আঘাত হানতে পারেন, তখন সীমান্ত অতিক্রম করার কোনো প্রয়োজন নেই।”
কাজিম আলম : টিআরটি ওয়ার্ল্ডের স্টাফ রাইটার