Search

Search

এক্সক্লুসিভ ব্রেকিং নিউজ পেতে আপনার মোবাইল নম্বরটি দিন

চিন্তা করবেন না, আমরা স্প্যাম করি না!

চীনা জে-১০সি কী রাফালের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে?

কার্যত অস্তিত্বহীন শিল্পভিত্তির চীন ১৯৮০-এর দশকের শুরু পর্যন্ত একটি স্বল্পআয়ের দেশই ছিল। যেখানে প্রতি ১০ জনে ৯ জনই চরম দারিদ্র্য সীমার মধ্যে জীবনযাপন করতেন। কিন্তু থেমে থাকেননি দেং শিয়াওপিং, যাকে আধুনিক চীনের রূপকার বলা হয়, যিনি ওই দশকে দেশের নেতৃত্ব দেন। তিনি চিন্তা করেছিলেন দেশীয় প্রযুক্তিনির্ভর যুদ্ধবিমান তৈরির, যা পশ্চিমা নকশার অনুপ্রবেশকারী বিমানগুলোর মোকাবিলা করতে পারবে।


এই ‘নতুন ধরনের’ চীনা বিমান তৈরির কাজ এতটাই বিশাল ছিল যে, এটি দেং-এর ১১ বছরের শাসনকালের গণ্ডি পেরিয়ে যায়।


১৯৯৪ সালে তাঁর উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন যখন উড়োজাহাজ নির্মাণ সাইট পরিদর্শনে যান, তখন তিনি বলেছিলেন, চীন এমন একটি যুদ্ধবিমান তৈরি করছে যা ‘পারমাণবিক বোমার চেয়েও বেশি কার্যকর’।

এই জে-১০ যুদ্ধবিমানকে সম্পূর্ণরূপে গড়ে তুলতে বেইজিংয়ের সময় লাগে প্রায় দুই যুগের বেশি। এটি এমন এক প্রাণঘাতী উড়ন্ত যন্ত্র, যা আকাশে আকাশযুদ্ধে যেমন দক্ষ, তেমনি ভূমিতে আঘাত হানতেও সক্ষম। যুদ্ধবিমানটি ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে কার্যকর হয় এবং ২০১৮ সালে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়।

কিন্তু ৭ মে ভোরে এই যুদ্ধবিমান প্রথমবারের মতো সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয় — যা বিমানসংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় আকাশযুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে।


চীনের ‘আয়রনক্ল্যাড’ মিত্র পাকিস্তান একমাত্র দেশ যারা চীনের বাইরে এই জে-১০সি যুদ্ধবিমান পরিচালনা করে। এটি এই সিরিজের তৃতীয় ও সর্বশেষ সংস্করণ।


পাকিস্তান বিমান বাহিনী (PAF) দাবি করেছে, তারা তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গে ৭ মের ডগফাইটে পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে, যার মধ্যে তিনটি ফ্রান্সের তৈরি রাফাল — যেগুলো এতদিন পর্যন্ত কখনোই ভূপাতিত হয়নি।

ভারতীয় বিমান বাহিনী (IAF) এপর্যন্ত কোনো বিমান হারানোর কথা স্বীকার করেনি, যদিও মার্কিন ও ফরাসি কর্মকর্তারা রাফালের ভূপাতিত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন।


রাফাল একটি বহুমুখী ফরাসি যুদ্ধবিমান, যা বিশ্বের অন্যতম উন্নত ও দক্ষ ৪.৫ প্রজন্মের বিমান হিসেবে বিবেচিত। ২০২০-২২ সালের মধ্যে ভারত এটি সংগ্রহ করে এবং এটি এখন ভারতীয় বিমান বাহিনীর অস্ত্রভাণ্ডারের শীর্ষ হাতিয়ার।


পশ্চিমা বিশ্বের যুদ্ধে পরীক্ষিত একটি বিমানের বিপরীতে জে-১০সির এই প্রথম ও সফল যুদ্ধ-অভিজ্ঞতা চীনের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এর আগে নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা একে কেবল ‘মার্কিন এফ-১৬ এর গড়পড়তা সমতুল্য’ বলেই বর্ণনা করতেন।


সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে কি বলা যায় — তুলনামূলক কম খরচের এই চীনা জে-১০সি এখন রাফালের একটি যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে?


চীনা যুদ্ধবিমান নিয়ে সাতটি বইয়ের লেখক ও সামরিক বিমান প্রযুক্তি বিশারদ আন্দ্রেয়াস রুপ্রেখট টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন, এখনই জে-১০সি ও রাফাল তুলনা করাটা সরলীকরণ হবে, কারণ চীনা বিমানের কর্মক্ষমতা নিয়ে প্রকাশ্য তথ্য খুব সীমিত।


তিনি বলেন “এটি প্রথম ইঙ্গিত যে চীনা প্রযুক্তি আসলে আধুনিক। পশ্চিমা দেশগুলো এবং ভারতও হয়তো এটা দেখে অবাক হবে — এটা না ‘জাঙ্ক’ (অপ্রয়োজনীয়) না ‘একটি কপি (নকল)’। ভারত হয়তো তাদের রাফালকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়েছে, অথবা চীনা বিমানকে অবমূল্যায়ন করেছে, বলেন রুপ্রেখট।


সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের সামরিক প্রযুক্তিবিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক মাউরো জিলি টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন, ৭ মের আকাশযুদ্ধ সম্পর্কে এখনো অনেক কিছু অজানা, ফলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়া কঠিন। তিনি মন্তব্য করেন, “আমরা এখনো অনেক কিছু জানি না। রাফালের পতন হয়তো পাইলট, মিশন পরিকল্পনাকারী বা অন্যদের ভুলের ফলও হতে পারে।"


বেইজিং কী নিজের যুদ্ধবিমান তৈরিতে বাধ্য হয়েছিল ?


১৯৮০-এর দশকের শুরুতে চীনে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে চারজন ভুগছিল অপুষ্টিজনিত উচ্চতা কমে যাওয়ার সমস্যায়। তবু দেশটি যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া বা ফ্রান্সের মতো বড় যুদ্ধবিমান নির্মাতা দেশ থেকে বিমান কেনার বদলে দেশীয় প্রযুক্তিতে নিজস্ব সামরিক বিমান তৈরির জন্য বিপুল অর্থনৈতিক সম্পদ বরাদ্দ করেছিল।


সাধারণত একটি নতুন যুদ্ধবিমান তৈরির জন্য কমপক্ষে ৩০ শতাংশ প্রযুক্তি এবং বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ নতুনভাবে ডিজাইন করতে হয়। কিন্তু চীনের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে জে-১০ তৈরি করতে ৬০ শতাংশ প্রযুক্তিই ‘সম্পূর্ণ নতুনভাবে’ উদ্ভাবন করতে হয়েছিল। “চীন বৈধ ও অবৈধ উভয় পথেই বিদেশি প্রযুক্তি ও জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করেছে এবং এখনো সেই চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে,” বলেন গবেষক মাউরো জিলি।


এই মতামতের সঙ্গে একমত আন্দ্রেয়াস রুপ্রেখটও। তিনি বলেন, “চীনের সামনে কখনোই পছন্দের সুযোগ ছিল না। তারা যাদের কাছ থেকে প্রযুক্তি কিনতে চায়, তারা বিক্রি করতে চায়নি। ফলে চীনকে ব্যাপক বিনিয়োগ ও কঠোর পরিশ্রম করে জে-১০ তৈরি করতে হয়েছে।”


জে-১০ তৈরি করা হয়েছিল পুরনো ও অপ্রচলিত জে-৭ যুদ্ধবিমানের পরিবর্তে। চীন যখন উন্নত প্রযুক্তির অভাবে নানা গুরুতর কারিগরি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, তখন তারা নিজস্ব মহাকাশ প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে এবং অন্য দেশগুলোর কাছ থেকে কৌশল শিখে নেয় — সরাসরি অনুকরণ না করেই।


১৯৮০-এর দশকের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত হওয়ায় চীন স্বল্প সময়ের জন্য পশ্চিমা প্রযুক্তির কিছুটা সুবিধা পায় — রাডার ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারে।


এর মধ্যে ইসরায়েলের লাভি (Lavi) যুদ্ধবিমান সম্পর্কেও চীন কিছু জ্ঞান অর্জন করে। তবে রুপ্রেখট জোর দিয়ে বলেন, জে-১০ কখনোই লাভি-এর কপি নয়।


১৯৮৯ সালের তিয়ানআনমেন স্কয়ারে বিক্ষোভ দমন ও ‘পিস পার্ল’ নামে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সামরিক সহযোগিতা কর্মসূচির অবসানের পর পশ্চিমের সঙ্গে চীনের সামরিক সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর বেইজিং প্রযুক্তির জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পরে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। রুপ্রেখট বলেন, সোভিয়েত পতনের পর ১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ার অর্থনৈতিক দুরাবস্থার সুযোগে বেইজিং মস্কোর উন্নত প্রযুক্তি ক্রয় করে — যা জে-১০ প্রকল্পের সফলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।


তিনি বলেন, “এর ফলেই আজ একটি সম্পূর্ণ স্বনির্ভর প্রযুক্তি ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে, যার মাধ্যমে চীন পুরোপুরি নিজেরাই জে-১০ উৎপাদন করতে পারে।"


এই বিমানে কতটা প্রযুক্তি আসলে ‘নতুন’ জিজ্ঞেস করা হলে, রুপ্রেখট বলেন, এখন এই প্রশ্নটাই ‘অপ্রাসঙ্গিক’। “আমি বলব, জে-১০–এ চীনের নিজস্ব প্রযুক্তির অংশ এখন ১০০ শতাংশ।”


--- কাজিম আলম, টিআরটি ওয়ার্ল্ডের স্টাফ রাইটার

সম্পর্কিত খবর :

;