পাকিস্তান কি পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে?

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া সামরিক উত্তেজনার পর চার দিন আগে দুই দেশ একটি যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে পৌঁছালেও, যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্য নিয়ে তাদের দাবির মধ্যে বেশ কয়েকটি মূল পার্থক্য এখনো রয়ে গেছে।
এর মধ্যে অন্যতম হলো পাকিস্তানের দাবি—তারা ৭ মে, অর্থাৎ সংঘর্ষের প্রথম দিন, ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে। পাকিস্তান বলছে, এটি ছিল তাদের ভূখণ্ডে ভারতীয় হামলার জবাব।
প্রকৃত সংঘর্ষের চেয়ে এখন কথার লড়াই সামনে চলে এসেছে। এই দাবি নিয়ে এখন পর্যন্ত কী জানা গেছে তা বিশ্লেষণ করেছে আল জাজিরা। খতিয়ে দেখা হয়েছে, এটি যদি সত্যি হয়, তাহলে কেন তা গুরুত্বপূর্ণ।
ঘটনাটি কীভাবে ঘটল?
৭ মে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা সামরিক সংঘর্ষে রূপ নেয়, যখন পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের ছয়টি শহরে নয়টি স্থানে ভারত হামলা চালায়।
ভারত জানায়, ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগাম এলাকায় সন্ত্রাসীদের হামলায় ২৫ জন পুরুষ পর্যটক ও একজন স্থানীয় ঘোড়াওয়াল নিহত হওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে তারা "সন্ত্রাসী অবকাঠামো" লক্ষ্য করে হামলা চালায়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই হামলাকারীদের সহায়তার অভিযোগ করে ভারত, যদিও ইসলামাবাদ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
পাকিস্তান জানিয়েছে, ৭ মে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের দুটি শহর এবং পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ পাঞ্জাবের চারটি স্থানে হামলা চালায়। এতে বেসামরিক নাগরিক নিহত হয় বলে পাকিস্তানের দাবি।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং পাকিস্তানের এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ভারতীয় বাহিনী কেবল তার দেশের নিরীহদের ক্ষতি করেছে এমন লক্ষ্যবস্তুতেই হামলা চালিয়েছে।
পরবর্তী চার দিন দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী একে অপরের বিমানঘাঁটিতে পাল্টা হামলা চালায় এবং একে অপরের ভূখণ্ডে ড্রোন পাঠায়।
পারমাণবিক সংঘর্ষের আশঙ্কা জেগে উঠলে, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা ভারত ও পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন সংঘর্ষ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে। ১০ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ওয়াশিংটনের মধ্যস্থতায় দুই দেশের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে। শুরুতে উভয় পক্ষই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুললেও, এখন পর্যন্ত সেটি কার্যকর রয়েছে।
পাকিস্তান মঙ্গলবার জানিয়েছে, ভারতীয় হামলায় তাদের ৫১ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ১১ জন সেনা ও কয়েকজন শিশু রয়েছে। অন্যদিকে ভারত জানিয়েছে, তাদের কমপক্ষে ৫ জন সেনা ও ১৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে।
পাকিস্তান কী দাবি করেছে?
৭ মে'র হামলার পরপরই আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার বলেন, ভারতের হামলার জবাবে ইসলামাবাদ পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান, একটি ড্রোন এবং বেশ কয়েকটি কোয়াডকপ্টার ভূপাতিত করেছে।
পরে সেদিনই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আহমেদ শরীফ চৌধুরী বলেন, যুদ্ধবিমানগুলো সবই ভারতের আকাশসীমার মধ্যে গুলি করে নামানো হয়েছে, এবং উভয় পক্ষের কোনো বিমানই একে অপরের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেনি—এই বক্তব্য ভারতের পক্ষ থেকেও সমর্থন করা হয়েছে।
লন্ডনের কিংস কলেজের যুদ্ধ অধ্যয়ন বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর এবং ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক মাইকেল ক্লার্ক আল জাজিরাকে বলেন, “ভারত ও পাকিস্তান—দুই দেশই তাদের নিজ নিজ আকাশসীমা থেকে হামলা চালানোর জন্য যথেষ্ট দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তাই তাদের বিমান বাইরে যাওয়ার দরকার পড়েনি।”
শুক্রবার পাকিস্তানের এয়ার ভাইস মার্শাল আওরঙ্গজেব আহমেদ দাবি করেন, পাকিস্তান যে পাঁচটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছে তার মধ্যে তিনটি ছিল রাফাল, একটি মিগ-২৯ এবং একটি সু-৩০। তিনি এসব বিমানের ইলেকট্রনিক সিগন্যাল ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুনির্দিষ্ট স্থানও উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, এই লড়াইটি চলে এক ঘণ্টার একটু বেশি সময় ধরে। এতে ভারতের কমপক্ষে ৬০টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয়, যার মধ্যে ১৪টি ছিল ফরাসি নির্মিত রাফাল। অন্যদিকে পাকিস্তান ৪২টি “হাই-টেক যুদ্ধবিমান” ব্যবহার করে, যার মধ্যে ছিল আমেরিকান এফ-১৬, চীনা জেএফ-১৭ এবং জে-১০।
ভারতের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম দ্য গ্লোবাল টাইমস যখন পাকিস্তান ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার খবর প্রকাশ করে, তখন চীনে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস সেটিকে “ভুল তথ্য” বলে আখ্যা দেয়। তবে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই দাবিগুলোর সত্যতা নিশ্চিত বা অস্বীকার—কোনোটাই করেনি।
এই প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলে ভারতের বিমান বাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল অব এয়ার অপারেশন্স একে ভরতি সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, “আমরা এখন একটি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রয়েছি এবং ক্ষয়ক্ষতি এ ধরনের পরিস্থিতিরই অংশ। বিস্তারিত নিয়ে এখন কিছু বলতে চাই না, কারণ এটি শত্রুপক্ষকে সুবিধা দিতে পারে। আমাদের সব পাইলট ঘরে ফিরেছেন।”
আর কী জানা গেছে?
সরকারি বক্তব্য ছাড়াও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম পাকিস্তানের দাবির বিভিন্ন রূপ প্রকাশ করেছে। ভারতীয় নিরাপত্তা সূত্রগুলো আল জাজিরাকে জানিয়েছে, তিনটি যুদ্ধবিমান ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে তারা নিশ্চিত করেনি এসব বিমান ভারতের নাকি পাকিস্তানের।
যেহেতু উভয় পক্ষই বলছে যে পাকিস্তানি বিমান ভারতীয় আকাশসীমা অতিক্রম করেনি, তাই ভারত-নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে পড়ে থাকা ধ্বংসাবশেষ সম্ভবত ভারতীয় যুদ্ধবিমানের।
রয়টার্স ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের চারটি সরকারি সূত্রের বরাতে জানায়, তিনটি যুদ্ধবিমান ওই অঞ্চলে বিধ্বস্ত হয়েছে। সিএনএন-এর খবরে অন্তত দুটি বিমানের বিধ্বস্ত হওয়ার তথ্য আসে, আর একটি মার্কিন সূত্রের বরাতে বলা হয়, অন্তত একটি রাফাল যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে।
এদিকে এপি সংবাদ সংস্থার ফটোগ্রাফারদের তোলা ছবিতে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলায় একটি বিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।
দুই পক্ষ কি কখনও একমত হবে?
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক মাইকেল ক্লার্ক বলেন, যদি ভারত সত্যিই একটি রাফাল হারিয়ে থাকে, তবে এটি ভারতের জন্য "লজ্জাজনক" হবে।
তিনি বলেন, “যদি রাফালটি ভারতের ভূখণ্ডেই পড়ে থাকে, তবে ভারত যতদিন সম্ভব এটিকে গুজব হিসেবেই রাখতে চাইবে। ভারত বলেছে ‘ক্ষয়ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী’, আর এটিই সম্ভবত নির্দিষ্ট কোনো বিমান হারানোর সবচেয়ে কাছাকাছি স্বীকারোক্তি যা তারা বর্তমানে দেবে।”